দায়িত্বশীল গেমিং
আপডেট: ১০.১০.২০২৪
গেমিং (জুয়া) সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে একটি জনপ্রিয় বিনোদনের মাধ্যম হয়ে উঠেছে। যদিও বেশিরভাগ খেলোয়াড় একে বেশি আকৃষ্ট বা উত্তেজিত না হয়ে শখের মতো উপভোগ করেন কিন্তু কিছু মানুষ জুয়া খেলার মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে। কখন থামা উচিত? বা খেলায় কতটা বিনিয়োগ করা উচিত? এটি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত একটি বিষয়, তবে নিশ্চিতভাবেই আপনার জীবন বাজি ধরার মতো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়।
সম্ভাব্য সমস্যা গুলি এড়াতে, আপনার পরিস্থিতি বিবেচনা করা উচিত: ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিকগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করুন। জুয়া খেলার কিছু ইতিবাচক দিকগুলোর মধ্যে হলো:
- আপনি একঘেয়ে বোধ করবেন না
- জয়লাভের বিশেষ গুরুত্ব বুঝতে পারা যায়
- সহজে শুরু করা যায় এবং সহজেই শেষ করা যায়
- এর ভিতরে একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জগত রয়েছে
এবার নেতিবাচক দিকগুলো দেখুন:
- সামাজিক চাপ (আপনার বন্ধুরা হয়তো বিরোধীতা করতে পারে)
- অর্থ হারানোর সম্ভাবনা
- কিছু সময়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হতে পারে
- ঝুঁকি অনেক বেশি
জুয়া আসক্তি কতটা বিপজ্জনক?
জুয়া আসক্তিকে আমরা একটি ব্যক্তির মানসিক সমস্যা হিসেবে দেখতে পারি। উদাহরণস্বরূপ, আপনি ক্লেপটোম্যানিয়া, পাইরোম্যানিয়া, বা মাদকাসক্তির দিকে তাকালে দেখতে পাবেন, এগুলো সবই মানসিক সমস্যা।
একজন আসক্ত খেলোয়াড় সমস্যার গুরুত্ব সবসময় বুঝতে পারবেন না এবং পরিস্থিতি যথাযথভাবে মূল্যায়নও করতে পারবেন না। একজন আসক্ত ব্যক্তির মনে হতে পারে যে তিনি যেকোনো সময় এই ক্ষতিকারক অভ্যাস থেকে মুক্ত হতে পারবেন। দুর্ভাগ্যবশত, এটি এত সহজে সম্ভব নয়। অনেক সময়, মানুষ শুধুমাত্র নিজেদেরই নয়, আশেপাশের লোকদেরও ক্ষতি করতে পারে, তাই সম্ভাব্য ক্ষতি সম্পর্কে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। জুয়া আসক্তির বিভিন্ন রূপ রয়েছে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো :
দৈনন্দিন সমস্যাগুলো
- ক্ষতিকারক আসক্তি টি দীর্ঘদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, যা সব সময় নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
- শখটি শুধুমাত্র আপনার কাজকেই নয় বরং ব্যক্তিগত জীবনকেও প্রভাবিত করে।
- একজন আসক্ত ব্যক্তি বাস্তবতাকে বিকৃত করে এবং অর্থ নষ্ট করার ব্যাপারে মিথ্যা বলতে থাকে।
- সময়ের সাথে সাথে, আসক্ত ব্যক্তি লক্ষ্য করে যে এই আসক্তি তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
- বাধ্যতামূলক আচরণ
- বারবার খেলার প্রবণতা সব কিছুকে ছাপিয়ে উঠে, অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসে
- পরিণতির ব্যাপারে আগে থেকে বিবেচনা না করা।
- প্রতিটি জয়ের কৃতিত্ব নিজেকে দেওয়া এবং ব্যর্থতাকে গ্রহন করা কষ্টকর হয়ে যায়
- এই ধরণের আসক্তিকে সাধারণত একটি মানসিক সমস্যা হিসেবে গণ্য করা হয়
- মাদকাসক্তির মত আসক্তি
- দিনের বেলা একজন ব্যক্তি সুস্থ মনমানসিকতার পরিচয় দিলেও জুয়ার পরিবেশের প্রভাবের ফলে সম্পূর্ণ ভিন্ন আচরণ প্রদর্শন করে।
- একজন ব্যক্তি সাধারণত নিজের সামাজিক খ্যাতি অর্জন করে কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে জুয়ার প্রতি আসক্তি প্রদর্শন করে না।
- সাফল্যের মুহূর্তে, একজন আসক্ত ব্যক্তি এমন ভাবে এগিয়েই যেতে চায় যেন তা কখনো শেষ হবে না।
- ব্যর্থতার সময়, একজন ব্যক্তি ঝুঁকি নিতে চায় না এবং খেলা চালিয়ে যাওয়া বা বন্ধ করার বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে না।
কীভাবে জুয়া আসক্তি শনাক্ত করবেন?
যদি আপনার কোনো বন্ধু বা পরিবারের সদস্য অত্যন্ত অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে এবং তার মধ্যে জুয়া আসক্তির লক্ষণ দেখা দেয়, তবে আপনার জন্য কিছু স্পষ্ট লক্ষণ পর্যবেক্ষণ করা গুরুত্বপূর্ণ, যা এই সমস্যাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে সহায়ক হতে পারে।
নিচের তালিকায় এমন কিছু লক্ষণ দেওয়া হলো, যা আপনি গত ৬-১২ মাসের মধ্যে লক্ষ্য করে থাকতে পারেন। যদি সেই ব্যক্তির কোনো মানসিক রোগ না থাকে বা তিনি বিষণ্নতায় ভুগছেন না, তবে এই লক্ষণগুলো সঠিকভাবে শনাক্ত করার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক
অ্যাসোসিয়েশনের নির্ধারিত মানদণ্ডের ভিত্তিতে জুয়া আসক্তির লক্ষণগুলোকে সহজেই সনাক্ত করা সম্ভব।
- গেম্বলিং কমানোর চেষ্টা করার সময় খিটখিটে মেজাজ ও উদ্বেগের লক্ষণ দেখা দেয়।
- গেম শেষ করার চেষ্টা বার বার ব্যর্থ হয় এবং দ্রুত গেমিংয়ে ফিরে আসে।
- গেম্বলিং সবসময় মাথায় থাকে (আলোচনার বিষয়, মজার বিষয়, এবং খেলার জন্য টাকা খোঁজা)।
- মানসিক আঘাত (বিষণ্ণতা, অসহায়ত্ব, উদ্বেগ, বা অপরাধবোধ) থেকে মুক্তির চেষ্টা।
- আর্থিক ক্ষতি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা (ক্ষতি পূরণের প্রচেষ্টা)।
- গেমিংয়ের অভিজ্ঞতা এবং আর্থিক ক্ষতির বিষয়ে ক্রমাগত মিথ্যা বলা।
- ব্যক্তিগত জীবন, কাজ বা জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলা।
- ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানের জন্য অন্য কারো অর্থের সন্ধান করা।
যদি এই তালিকা থেকে ৪ বা তার বেশি লক্ষণ মিলে যায়, তবে এটি স্পষ্ট যে আপনি জুয়া আসক্তির সমস্যার দ্বারা ভুক্তভোগী। পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবতসকযাচাই বাছাই করার জন্য একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক (যেমন থেরাপিস্ট বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ) এর সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। আপনাকে আপনার সমস্যার বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে যাতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করতে পারেন এবং সঠিক চিকিৎসার পদক্ষেপ নিতে পারেন।
একজন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আপনাকে সম্ভাব্য মানসিক ব্যাধি বাদ দিতে সাহায্য করবেন, যা এই অদ্ভুত আচরণের একটি কারণ হতে পারে। সাধারণত, জুয়া আসক্তির পেছনে আরও অনেক মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা থাকে, যা আপনার চেতনার মধ্যে অস্থিরতা এবং উদ্বেগ সৃষ্টি করে। বিষণ্নতা, উদ্বেগ এবং মাদকাসক্তি এর কারণগুলির মধ্যে থাকতে পারে। শুধুমাত্র একজন বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমেই আপনি আপনার সমস্যার মূল খুঁজে পেতে পারেন এবং আপনার অবস্থা উন্নত করার কাজ শুরু করতে পারেন।
লুডোম্যানিয়া: বিপদজনক আসক্তির পথ
লুডোম্যানিয়া (বর্তমান চিকিৎসা পরিভাষা অনুযায়ী) হলো জুয়ার একটি গুরুতর আসক্তি, যা সাধারণত মানসিক সমস্যার একটি প্রকাশ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এর পেছনে সামাজিক, মানসিক এবং জৈবিক বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। এই আসক্তির উৎস কেবল একটি কারণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নাও থাকতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করে থাকেন যে, আসক্ত ব্যক্তির বয়স এই অসুস্থতার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এছাড়া, একজন ব্যক্তির জুয়া খেলার সময় জয় পরাজয়ের প্রতি তাদের মনোভাবও আসক্তির তীব্রতা নির্ধারণ করে।
জৈবিক দিক
জুয়া আসক্তির পেছনে জৈবিক কারণ একটি বড় ভূমিকা পালন করে যা বিভিন্নধরণের মানসিক সমস্যার দিকে ধাবিত করে থাকে। ইলিনয়ের অ্যাডিকশন রিকভারি ইনস্টিটিউটের গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, জুয়া খেলার সময় শরীরে এমন কিছু রাসায়নিক নির্গত হয় যা মাদক সেবনের প্রভাবের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। জয়ের আবেগতাড়িত অনুভূতির সাথে যখন মস্তিষ্কের নিউরোলজিক্যাল প্রতিক্রিয়া হয় তখন তা অনেকটা মাদক সেবনের মতো। অতঃপর, এই খেলা ছাড়ার চেষ্টা মানসিকের সাথে সাথে শারীরিক সমস্যার উদ্ভব ঘটায় যা অনেকটা মাদকাসক্তির মতো।
মস্তিষ্ক স্ক্যান টেস্ট সাধারণত ভেতর থেকে সমস্যা গুলো চিহ্নিত করে। এখান থেকে বোঝা যায়, জয়ের অনুভূতি থেকে আমাদের স্নায়ুর অনুভব করার ক্ষমতা অনেকটা মাদক সেবনের মতো হয়ে যায়। ধীরে ধীরে আমাদের দেহ জয়ের এই অনুভূতির সাথে মানিয়ে নেয়। যার ফলে বাস্তব জীবনে অন্যান্য অনুভূতি এবং আবেগ অনুভব কর করা কঠিন হবে । পরিশেষে সব সবকিছুর খেলায় ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
শরীরে সেরোটোনিন এবং নোরএপিনেফ্রিনের মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ হরমোনের ঘাটতি থাকলে তা আবেগ এবং আচরণের উপর প্রভাব ফেলে যা বিভিন্ন ধরণের আবেগের সাথে জড়িত (সুখ, বাধ্যতামূলক আচরণ, উত্তেজনা অথবা মানসিক চাপ) । এর ফলস্বরূপ, অনলাইন ক্যাসিনোতে আসক্তি একজনের শরীরে বিদ্যমান কিছু ঘাটতির একটি প্রকাশ হতে পারে।
মানসিক দিক
জুয়ার প্রতি আপনার মনোভাব আপনার মানসিক অবস্থার ব্যাপারে অনেক কিছু প্রকাশ করে, গেমের প্রতি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি নাটকীয়ভাবে আলাদা হতে পারে (গ্যাম্বলারস ফ্যালেসিকে আমরা উদাহরণ হিসেবে নিতে পারি)
গ্যাম্বলার্স ফ্যালাসি আসলে একটা ভুল ধারণা, যেখানে মনে করা হয় যে খেলার ফলাফল স্বাধীন ঘটনাপ্রবাহ (জয়) দিয়ে প্রভাবিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, আমরা প্রায়ই ভাবি যে একটা ঘটনা যদি অনেকবার ঘটে, তাহলে ভবিষ্যতে সেটা আর হবে না বা হওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু আসলে প্রতিটা ঘটনা একে অপরের থেকে আলাদা, আর আগের ঘটনা ভবিষ্যতের ওপর কোনো প্রভাব ফেলে না।
‘মন্টে কার্লো ফলেসি’ এর একটি স্পষ্ট উদাহরণ। ১০০ বছর আগে একবার ক্লাসিক রুলেট খেলায় কালো রঙ ২৬ বার পরপর এসেছে। অনেক খেলোয়াড়রা মার্টিঙ্গেল স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এবং তারা প্রচুর টাকা হারিয়েছিল। জুয়া আসক্ত ব্যক্তিরা প্রায়ই তাদের ব্যর্থতাকে নিজের দোষ বলে মনে করেন এবং ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় আবার খেলা শুরু করেন। দুর্ভাগ্যবশত, ভাগ্যের কোনো স্মৃতি নেই, এবং বাগ্য আপনার প্রতি দায়বদ্ধ নয়।
কগনিটিভ বায়াস বা বিকৃত চিন্তাধারাও মানসিক সমস্যার একটি বড় অংশ। এই কল্পনা প্রসূত ধারণাগুলো বাস্তব পরিস্থিতি থেকে দূরে রাখে যার ফলে কুসংস্কারে বিশ্বাস, সমস্যা অস্বীকার করা বা জয়ে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তোলে। ভিডিও স্লটগুলি আরও সমস্যা মূলক, কারণ এগুলো ব্যক্তির মানসিক অবস্থার খারাপ দিকগুলো সহজেই প্রকাশ করে।
সামাজিক দিক
অন্যান্য মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার মতো, লুডোম্যানিয়ার পেছনে সামাজিক দিকও বড় ভূমিকা পালন করে। ব্যক্তিগত জীবনে বা কর্মক্ষেত্রে সমস্যার সঙ্গে উচ্চ মাত্রার মানসিক চাপ যুক্ত হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। তবে, বাইরের পরিবেশ সবসময় এই সমস্যার প্রধান কারণ নয়।
সামাজিক পরিবেশে সমস্যা থাকলে মানুষ বড় ঝুঁকি নিতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। যেমন, এমন পরিবারে যেখানে নিয়মিত জুয়ার চর্চা হয়, সেখানে মানসিক সমস্যাগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। এই ক্ষেত্রে, ছোট বয়স থেকেই মানুষ এই প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়ে এবং তারা সবসময় বুঝতে পারে না, বিষয়টির গুরুত্ব কী।
বিষণ্ণতা, উচ্চ মাত্রার মানসিক চাপ, একাকীত্ব (পরিবার বা বন্ধুদের মধ্যে উপেক্ষা বা বিচ্ছিন্নতা অনুভব করা) – এসব জিনিস লুডোম্যানিয়ার ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয়।
কমর্বিড দিক সমূহ
কমর্বিডিটি হলো একাধিক সমস্যার সমন্বয় যা একটি মূল রোগের প্রেক্ষাপটে দেখা দেয়। এই সমস্যাগুলো প্রায়ই নির্ণয় করা এবং সনাক্ত করা বিশেষজ্ঞদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ায়, কারণ একাধিক মানসিক বা শারীরিক সমস্যার উপস্থিতি থাকে।
জুয়া আসক্তির সঙ্গে যুক্ত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো:
- মদ্যপানের সমস্যা (অ্যালকোহল আসক্তি)
- মাদকাসক্তি
- ব্যক্তিত্বজনিত বা বিষণ্নতা সম্পর্কিত ব্যাধি
- উদ্বেগজনিত সমস্যা
উপরের তালিকার যেকোনো সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন কি না সেই বিষয়ে চিন্তা করে দেখুন। এই সমস্যাগুলো একজন ব্যক্তির মানসিক অবস্থাকে আরও জটিল করে তোলে এবং জুয়া আসক্তির ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দেয়। যদি আপনার মধ্যে এই সমস্যাগুলোর কোনোটি পাওয়া যায়, তবে একজন চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন বিশেষজ্ঞের সহায়তায় আপনার সমস্যার সঠিক নির্ণয় করা এবং সম্ভাব্য সমস্যা দূর করার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব।
জুয়ার নেতিবাচক দিকগুলো
জুয়ার জগতে নেতিবাচক পরিণতি মোটেই বিরল নয়। এর মধ্যে কিছু পরিণতি স্পষ্ট নয়, তবে অন্যগুলো খুবই পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়।
অর্থ এবং আর্থিক সমস্যা
বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই আসল অর্থ ব্যবহার করে জুয়া খেলেন, এবং বড় বাজি ধরা, বারবার টাকা জমা দেওয়া, এবং দীর্ঘ সময় ধরে খেলা আর্থিক সমস্যার দিকে নিয়ে যায়। যখন একজন আসক্ত খেলোয়াড় সব অর্থ হারিয়ে ফেলে, তখনও তারা কোথাও থেকে ঋণ নেওয়ার উপায় খুঁজে পায়। বড় বড় সম্পদ (যেমন বাড়ি, গাড়ি ইত্যাদি) হেরে যাওয়া একটি গুরুতর আর্থিক সমস্যার উদ্ভব ঘটায়, যা শেষ পর্যন্ত দেউলিয়াত্বের দিকে নিয়ে যেতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে, আর্থিক ক্ষতি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করতে গিয়ে মানুষ আইন ভেঙে ফেলে এবং আইনি সমস্যায় জড়িয়ে পড়ে। তারা ঋণ শোধ করতে কিংবা শুধু খেলায় ফিরতে আইনের সীমা অতিক্রম করতে দ্বিধা করে না।
মানসিক অবস্থা
মানসিক স্বাস্থ্যকে অনেক দিন ধরেই জুয়ার আসক্তির সবচেয়ে স্পষ্ট নেতিবাচক প্রভাবগুলোর একটি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। মানুষ সবসময় আত্মসমীক্ষায় প্রবণ হয় না, তাই তারা প্রায়ই তাদের মানসিক অবস্থার দিকে নজর দিতে ব্যর্থ হয়। সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া, কাজ বা ব্যবসা হারানো—এগুলো সবই মানসিক চাপ ও বিষণ্ণতা বাড়ায়, যা কখনও কখনও সবচেয়ে ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে: আত্মহত্যা।
এ কারণেই, গেমিং সেশনের আগে এবং পরে নিজের মানসিক অবস্থার মূল্যায়ন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সামাজিক প্রভাব
মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা শুধু আমাদের নিজেদেরই নয়, আমাদের চারপাশ এর পরিবেশ, পরিবার এবং প্রিয়জনদেরও প্রভাবিত করে। আসক্তির প্রাথমিক পর্যায়ে তারা আমাদের পাশে থাকে, কিন্তু এর গুরুতর রূপের বিধ্বংসী পরিণতির মুখোমুখি হতে হয় তাদেরও। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, আসক্তির সমস্যাযুক্ত পরিবারগুলোতে পারিবারিক সহিংসতা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। রোগের সব দিক বুঝতে পারলে, আপনার সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
ক্যারিয়ার এবং কাজের প্রভাব
নিয়ন্ত্রণ বিহীন জুয়া খেলা প্রায় সব সময়ই কাজের ওপর প্রভাব ফেলে। এটি একজন ব্যক্তির মোটিভেশন, উৎপাদনশীলতা এবং জীবনের লক্ষ্যগুলোর প্রতি প্রতিশ্রুতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অনেকেই কাজের সময় খেলায় নিমগ্ন হয়ে পড়েন এবং অফিসের কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। কাজে অনুপস্থিতির জন্য নানা অজুহাত তৈরি করেন, যার ফলে তাদের দীর্ঘমেয়াদী ক্যারিয়ার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বর্তমান আর্থিক অবস্থারও ক্ষতি হয়। অতএব, জুয়ার আসক্তি ব্যক্তিগত, সামাজিক, আর্থিক এবং পেশাগত জীবনের সব দিকেই বিধ্বংসী প্রভাব ফেলে, যা দীর্ঘমেয়াদে গভীর সমস্যার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
জুয়া সমস্যাগুলো কতটা সাধারণ?
জুয়া হল দ্রুত বিকাশমান বৈশ্বিক অর্থনীতির একটি প্রধান চালিকাশক্তি। প্রতি বছর এই খাত নতুন মুনাফার রেকর্ড সৃষ্টি করে এবং বহু বছর ধরে লক্ষাধিক কোটি ডলারের আয় দেখিয়ে আসছে। তবে, এই উত্থানশীল শিল্পে যেমন বিজয়ীরা আছে, তেমনি পরাজিতরাও আছে।
প্রতি বছর প্রায় ২০০ কোটি মানুষ তাদের ভাগ্য পরীক্ষা করেন। ক্যাসিনো, পোকার ক্লাব, স্পোর্টস বেটিং এবং এ ধরনের বিনোদনের প্রতি আগ্রহী মানুষের সংখ্যা প্রতিটি দেশেই দ্রুত বাড়ছে। ধারণা করা হয় যে প্রায় ৪২০ কোটি মানুষ কখনও না কখনও এই ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। এখন যদি এই সংখ্যার দিকে তাকাই, দেখা যাবে এটি বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি—এ থেকে বোঝা যায় জুয়া কতটা জনপ্রিয়!
গবেষণার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, একটি দেশের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার প্রায় ৫% নিয়মিত স্বশরীরে ক্যাসিনো তে যান। কিন্তু যখন অনলাইন ক্যাসিনোর কথা আসে, এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১২%।
প্রথাগত অফলাইন ক্যাসিনোও এখন বুঝে গেছে যে শুধুমাত্র আগত গ্রাহকদের উপর নির্ভর করা খারাপ ধারণা। তাই তারা প্রায় সবসময় অনলাইনেও তাদের পরিষেবা দেয়। এটি কেবল সস্তা এবং সুবিধাজনক নয়, বরং আরও ইন্টারেক্টিভও, কারণ শ্রোতাদের সাথে যোগাযোগ করার বিভিন্ন উপায় রয়েছে।
একজন গড় ক্যাসিনো খেলোয়াড় তার গেমে কত খরচ করেন?
- টেবিল গেম (রুলেট, ক্র্যাপস): গড়ে $৪৫
- কার্ড গেম (ব্ল্যাকজ্যাক, পোকার): গড়ে $৫০
- স্লট মেশিন: প্রায় $৪০-৪৫
এই তথ্যের ভিত্তিতে, কল্পনা করা যায় বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ খেলোয়াড়ের খেলা থেকে কী পরিমাণ মুনাফা তৈরি হয়। তবে যারা শুধুই মজা করেন তাদের মধ্যে প্রায় ১২% মানুষের জন্য এটি একটি খারাপ অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়ায়।
জুয়া আসক্তি মোকাবিলা কীভাবে করবেন?
যেকোনো শারীরিক বা মানসিক সমস্যার মতো, জুয়া আসক্তি মোকাবিলার প্রথম ধাপ হলো এটি শনাক্ত করা এবং একজন বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে সঠিক নির্ণয় করা। যদি মনে করেন যে জুয়া আপনার জীবনে সমস্যা তৈরি করছে, এবং এটি আপনার চিন্তা-ভাবনার ওপর প্রভাব ফেলছে, তাহলে চিকিৎসা শুরু করার জন্য অনেক উপায় রয়েছে। সারা বিশ্বে অনেক সাহায্য কেন্দ্র এবং পুনর্বাসন কেন্দ্র আছে, যেখানে জুয়া আসক্তির চিকিৎসা সম্ভব।
প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো একজন পেশাদার বিশেষজ্ঞের সহায়তা নেওয়া। একজন চিকিৎসক আপনার আসক্তির মাত্রা মূল্যায়ন করতে এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নির্ধারণ করতে সক্ষম হবেন। যদিও জুয়া আসক্তি দূর করার কোনো নির্দিষ্ট একক পদ্ধতি নেই, তবে বিভিন্ন পুনর্বাসন কৌশল একত্রিত করে সর্বোত্তম ফলাফল পাওয়া যায়।
চিকিৎসা হস্তক্ষেপ
যেমনটা আগেই বলা হয়েছে, জুয়া আসক্তি দূর করার জন্য কোনো বিশেষ ওষুধ নেই যা তাৎক্ষণিকভাবে এই আকর্ষণকে থামিয়ে দিতে পারে। তবে, এমন কিছু ওষুধ রয়েছে যা নিয়মিত সেবনের মাধ্যমে জুয়ার প্রয়োজনীয়তা কমাতে সহায়ক। ক্যাসিনোর উত্তেজনাপূর্ণ আবেগ থেকে যে অ্যাড্রেনালিন নিঃসরণ হয়, সেটির অভাব পূরণের জন্য এই ওষুধগুলো কার্যকর হতে পারে।
জুয়া আসক্তি প্রতিরোধ বা চিকিৎসার জন্য যে ওষুধগুলো ব্যবহৃত হয়, সেগুলো প্রায়শই অন্যান্য মানসিক রোগের চিকিৎসায়ও ব্যবহৃত হয়। এই মানসিক রোগগুলো সাধারণত বিষণ্নতা, উদ্বেগ, বা মানসিক অস্থিরতার সঙ্গে সম্পর্কিত। মূল লক্ষ্য হলো, একজন ব্যক্তিকে মানসিক স্থিতিশীলতায় ফিরিয়ে আনা, যাতে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে এবং পুনরায় জুয়ায় আসক্তির ঝুঁকি এড়ানো যায়।
পরামর্শ এবং থেরাপি
জুয়া আসক্তি মোকাবিলার অন্যতম কার্যকর পদ্ধতি হলো সাইকোথেরাপি বা মনোচিকিৎসা। একজন যোগ্যতাসম্পন্ন চিকিৎসক আপনার নির্দিষ্ট পরিস্থিতির ভিত্তিতে পরামর্শ প্রদান করতে পারেন এবং থেরাপির সেশনগুলো পরিচালনা করতে পারেন। বেশিরভাগ সময়, জুয়া আসক্তির পাশাপাশি অন্যান্য মানসিক রোগও বিদ্যমান থাকতে পারে, যা থেরাপি সেশনের সময় একজন চিকিৎসক সহজেই সনাক্ত করতে পারেন। এই থেরাপির মাধ্যমে একজন ব্যক্তি তাদের সমস্যা সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে পারেন এবং লুকিয়ে থাকা মানসিক সমস্যাগুলো সমাধানে সহায়তা পেতে পারেন। নিয়মিত থেরাপির মাধ্যমে নিরাময়ের সম্ভাবনা বেশ উচ্চ।
স্ব-সাহায্য বা দলগত সহায়তা
সবকিছু আপনার হাতে, বিশেষ করে জীবনকে আরও ভালোভাবে বদলানোর ইচ্ছা। নিজের অবস্থার মূল্যায়ন করে এবং আগের জীবনে ফিরে যাওয়ার একটি বড় লক্ষ্য স্থির করে, আপনি সফল চিকিৎসার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে পারেন। পাশাপাশি, আরেকটি কার্যকর পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন—গ্রুপ সাপোর্ট। এই ধরনের সহায়তা হল একই রকম সমস্যায় আক্রান্ত অজ্ঞাত ব্যক্তিদের সমাবেশ, যারা তাদের অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ে একা থাকতে চান না। বিভিন্ন সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে আসা অন্য মানুষের জীবনের দিকে তাকালে, আপনি বুঝতে পারবেন যে আপনার সমস্যা একক নয়। এমনকি আপনি হয়তো এমন মানুষ খুঁজে পাবেন যারা আপনার মতোই চিন্তা করে এবং সুস্থ জীবনের বন্ধু হয়ে উঠতে পারে।
আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন বহুদিন ধরে অনেক মানুষের জুয়ার আসক্তির সমস্যার সাথে পরিচিত, তাই তাদের আত্ম-চিকিৎসার কিছু সুপারিশ রয়েছে:
- বন্ধু বা আত্মীয়দের সাহায্য নেওয়া এবং অজ্ঞাত সহায়ক গোষ্ঠীতে যোগদান।
- বিকল্প কাজ এবং বিনোদনের খোঁজ করা—নিজেকে অন্য কোনো দিক দিয়ে খুঁজে বের করা।
- আপনার ইচ্ছাশক্তি নিয়ন্ত্রণ করা: নিজের অবস্থার পর্যবেক্ষণ এবং আসক্তি থেকে মুক্তির প্রক্রিয়া দেখা।
- আসক্তি আপনার কাজ এবং সামাজিক জীবনে কী দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে চিন্তা করা।
- অন্য কাউকে সাহায্য করা: আপনার মতো সমস্যার সম্মুখীন কাউকে খুঁজে বের করে তাকে এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করা।
যদি আপনি নিজেকে সাহায্য করতে না পারেন, তবে অন্যকে কীভাবে সাহায্য করবেন?
বেশিরভাগ মানুষ যারা জুয়া খেলে, তারা নিজের নিয়ন্ত্রণ হারায় না বা সমস্যার সম্মুখীন হয় না। কিন্তু তবুও, অনেকেই আছেন যাদের আসক্তি প্রতিদিন আরও খারাপের দিকে যায়। এমন একজনের জীবনের দিকে তাকিয়ে, আপনি আপনার জীবনকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার একটি অনন্য সুযোগ পাবেন।
আপনার সামাজিক পরিসরে যদি কেউ জুয়া আসক্তির সমস্যায় পড়ে থাকে, তবে তাকে একা ফেলে না রেখে সাহায্য করার চেষ্টা করা খুবই জরুরি। প্রচলিত ধারণা হলো, যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু করা যায় এবং সুস্থতার পথে হাঁটা যায়, খেলোয়াড়ের জীবনের ক্ষতি ততটাই কম হয়।
কিছু মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা, যেগুলোর মুখোমুখি আমরা প্রায়ই হই, বেশ জটিল। পেশাদার হস্তক্ষেপ, সমন্বিত পদ্ধতি এবং আত্ম-চিকিৎসা (সমস্যার স্বীকৃতি) লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বদলে দিচ্ছে বিশ্বজুড়ে। আজই শুরু করুন, এবং আগামীকাল নিজেকে ধন্যবাদ জানান!
সমস্যার লক্ষণ
সবকিছুই সমস্যার সংজ্ঞা নির্ধারণ থেকে শুরু হয়। যত তাড়াতাড়ি আপনি লক্ষ করেন, আপনার সহকর্মী, আত্মীয় বা বন্ধুর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি থাকে। সমস্যাটি বোঝার জন্য কিছু পরিষ্কার লক্ষণ রয়েছে:
- খেলার অভ্যাস সম্পর্কে মিথ্যা বলা (সমালোচনার ভয়ে)।
- খেলার জন্য অতিরিক্ত সময় ব্যয় করায় সম্পর্কের অবনতি।
- ব্যক্তি নিজে সমস্যাটি লক্ষ্য করতে পারে না বা এর অস্তিত্ব অস্বীকার করতে পারে।
- বারবার টাকা চাওয়া বা সর্বদা অর্থের সন্ধানে থাকা।
- খেলার সময় অনেক বেড়ে যাওয়া, ফলে ফ্রি সময় কমে যাওয়া (উপলব্ধি হয় না)।
- জুয়া খেলা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। একজন ব্যক্তি মৌলিক প্রয়োজনীয়তা বা বিল পরিশোধের পরিবর্তে জুয়ার জন্য অর্থ ব্যয় করে।
যদি এই তালিকা থেকে এক বা একাধিক লক্ষণ আপনি খুঁজে পান, তাহলে তা উপেক্ষা করবেন না। কিছু মানুষ সমস্যাটি দেখতে খুব কষ্ট পায়, তারা কথা বলতে বা সাহায্য চাইতে ভয় পায়। গঠনমূলক আলোচনা এবং বিচার না করে সাহায্যের প্রস্তাব দেওয়া সর্বোত্তম উপায়।
যদি আপনি অন্য কারও সমস্যাটি বুঝতে পারেন এবং সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় রাখা জরুরি:
- আপনার সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- নিশ্চিত করুন যে আপনি খেলার জন্য অর্থ যোগান দিচ্ছেন না (টাকা ধার দেবেন না)।
- প্রয়োজন অনুসারে আপনার সাহায্য প্রদান করুন।
এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে আসক্তির আর্থিক দায়িত্ব নেওয়া একটি খারাপ ধারণা। সাহায্য করার সেরা উপায় হল পেশাদার চিকিৎসা, কাউন্সেলিং, বা সাইকোথেরাপির খরচ বহন করা। এরপর আপনি ঋণ মেটানোর ব্যবস্থা করতে পারেন।
সরাসরি হস্তক্ষেপ
কাউকে সমস্যা স্বীকার করানো এবং বিশেষায়িত সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা বোঝানো সহজ কাজ নয়। তবে কিছু কৌশল আছে যা বড় সমস্যাটি বোঝাতে সাহায্য করতে পারে।
ইন্টারভেনশন কৌশলটি খুব কার্যকরী। এর মূল ভিত্তি হলো পরিবার ও বন্ধুবান্ধব খোলামেলা আলোচনায় অংশ নেবেন এবং খেলোয়াড়ের সামনে তাদের সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলবেন। আলোচনার সুর খুব গুরুত্বপূর্ণ—কোনো অভিযোগ বা দোষারোপ ছাড়াই ইতিবাচক ও সহানুভূতিপূর্ণ সুরে কথা বলা উচিত, যাতে তিনি আক্রমণের শিকার মনে না করেন। উদ্দেশ্য হলো প্রিয়জনদের উদ্বেগ তার মধ্যে অন্যদের গুরুত্ব বোঝার ইচ্ছা জাগিয়ে তুলবে এবং সামনের পথের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে সাহায্য করবে।
আপনি নিজেও এই কৌশলটি প্রয়োগ করতে পারেন, তবে একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়াও সহায়ক হতে পারে, যা আপনার পদক্ষেপগুলির কার্যকারিতা বাড়াতে পারে।
লুডোম্যানিয়া ও আত্মহত্যা প্রতিরোধ
লুডোম্যানিয়ার ক্ষেত্রে আত্মহত্যার উচ্চ হার এই আসক্তির মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবের আরেকটি বড় প্রমাণ। জুয়ার আসক্তির সাথে সাথে, অনেকেই উদ্বেগ বা বিষণ্ণতার মতো সমস্যা অনুভব করে, যা পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যায় এবং বড় বিপদের কারণ হতে পারে।
যদি মনে হয় কারো আত্মহত্যার প্রবণতা আছে, তাহলে সেই বিষয়ে খোলামেলা ও সৎভাবে কথা বলাটা খুব জরুরি। সে যেন ভয় না পায় কথা বলতে, সেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়, এটা তাকে বোঝানো দরকার।
আত্মহত্যা কোনো পথ নয়, এটা একজনের বুঝতে হবে। যদি মনে হয় পরিস্থিতি গুরুতর, তাহলে আপনার স্থানীয় আত্মহত্যা প্রতিরোধ হটলাইনে ফোন করুন। সেখানে একজন বিশেষজ্ঞ থাকবেন, যিনি আপনার সমস্যাগুলো শুনবেন এবং সাহায্য করবেন।
বিকল্প কী আছে?
পুরোপুরি বা আংশিকভাবে জুয়া থেকে সরে আসা কোনো শেষ লক্ষ্য নয়। আসক্তি থেকে মুক্তির মূল লক্ষ্য হলো স্ব-নিয়ন্ত্রণ এবং পুনরায় আসক্তি প্রতিরোধ করা।
জুয়ার সহজলভ্যতা বিশেষ করে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আমাদের সমাজে লুডোম্যানিয়া সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। তাই, চিকিৎসার পাশাপাশি বিকল্প বিনোদন খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত জরুরি। যদি আপনি নিজে এই সমস্যার মধ্যে না পড়ে থাকেন, তবে অন্য ধরনের স্বাস্থ্যকর বিনোদন এবং কার্যকলাপ খুঁজে বের করুন যা জুয়ার প্রতি আপনার আকর্ষণ কমিয়ে আনতে পারে।
জুয়া খেলার কারণ | বিকল্প সমাধান |
---|---|
আনন্দদায়ক প্রক্রিয়া যা রক্তে অ্যাড্রেনালিন নিঃসরণ করে | স্পোর্টস বা টিম ইভেন্টে অংশগ্রহণ করুন যা একই ধরনের উত্তেজনা দিতে পারে। কিছু অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস যেমন গোকার্টিং, রাফটিং, রক ক্লাইম্বিং, স্কিইং বা সাইক্লিং অ্যাড্রেনালিনের ঘাটতি পূরণ করতে পারে। |
মানুষের সঙ্গে মেলামেশার সামাজিক দিক | মানুষের সাথে মেলামেশা ব্যক্তিত্ব গঠনে বড় ভূমিকা রাখে। বইয়ের ক্লাব, জনসমক্ষে বক্তৃতা, স্বেচ্ছাসেবা এবং অন্যান্য সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্টে অংশগ্রহণের চেষ্টা করুন। এটা আপনার জন্য নতুন সুযোগ হতে পারে! |
জীবনের সমস্যা ভুলে শান্ত হওয়া | আত্মউন্নতির দিকে মনোযোগ দিন। মনে রাখবেন, জীবন একটাই এবং তা পূর্ণভাবে উপভোগ করতে হবে। বই পড়ুন, নতুন কিছু শিখুন, এবং জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে আনন্দময় করে তুলুন। |
একাকীত্ব দূর করা | আপনার আগ্রহের বিষয়ে অন্যদের সাথে ভাগ করে নিন। সিনেমা, সংগীত, বই, কমিকস—আপনার যা ভালো লাগে তা অন্যদের সাথে শেয়ার করুন, এবং আপনি দ্রুতই একই মনোভাবের মানুষের সাথে পরিচিত হবেন। |
টাকা উপার্জনের পেছনে ছুটে চলা | মনে রাখবেন, জুয়া খেলা মজার জন্য, উপার্জনের জন্য নয়। টাকা উপার্জনের সবচেয়ে ভালো উপায় হলো কাজ বা ব্যবসা। নিজেকে এই ক্ষেত্রে প্রমাণ করুন, এবং আপনি বাকিগুলো ভুলে যাবেন! |
লুডোম্যানিয়া: মিথ এবং বাস্তবতা
জুয়াকে ঘিরে প্রচুর ভুল ধারণা রয়েছে, যেগুলো থেকে সত্য এবং মিথ্যা পৃথক করা কঠিন হয়ে যায়। যদি জুয়া আপনার জীবনকে প্রভাবিত করে থাকে, তবে বাস্তব সত্যটি উপলব্ধি করা এবং প্রচলিত ভুল ধারণাগুলো উপেক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে শীর্ষ ৫টি মিথ এবং তাদের বাস্তবতা সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেওয়া হলো:
মিথ ১:
জুয়া কোনো সমস্যা নয়, যতক্ষণ না কেউ হারানো অর্থ মেনে নিতে সক্ষম হয় (এটিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়া বলে না )।
ফ্যাক্ট : জুয়ার সমস্যার সঙ্গে শুধুমাত্র অর্থ হারানোর বিষয়টি জড়িত নয়। আর্থিক সমস্যাগুলো সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং কঠিন হতে পারে, তবে জুয়া আসক্তির আরো অনেক গভীর প্রভাব থাকতে পারে। একটি বড় ভুল ধারণা হলো, শুধুমাত্র আর্থিক ক্ষতির বিষয়টিই এই রোগ নির্ণয়ের প্রধান উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়। বাস্তবে, আর্থিক সমস্যা ছাড়াও ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক সম্পর্ক, পেশাগত দায়িত্ব, এবং মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। অনেক সময়, একজন ব্যক্তি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ক্ষতি ছাড়াও জীবনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে ব্যাপক প্রভাব অনুভব করতে পারে। আর্থিক ক্ষতির চেয়ে মানসিক এবং সামাজিক ক্ষতি অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক হতে পারে।
মিথ ২:
শুধুমাত্র নিয়মিত খেলোয়াড়রাই আসক্তিতে পড়ে। মাঝে মধ্যে ক্যাসিনোতে যাওয়া ক্ষতিকারক নয়।
ফ্যাক্ট : জুয়া খেলায় নিয়মিত অংশগ্রহণ আসক্তির প্রধান বিষয় নয়। আসক্তি শুধুমাত্র খেলার ফ্রিকোয়েন্সির ওপর নির্ভর করে না। মাঝে মধ্যে খেলা এমন মানুষদের ক্ষেত্রেও সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, যাদের মানসিক স্বাস্থ্য অস্থিতিশীল বা যারা সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন। মদ্যপান, মানসিক চাপ, পারিবারিক সমস্যা বা ব্যক্তিগত হতাশার কারণে অনেক সময় অনিয়মিত খেলোয়াড়রাও দ্রুত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে পারেন। তারা মাঝে মধ্যে খেললেও, এক রাতে বা একাধিকবার খেলার সময় এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যা পরে তাদের জীবনকে জটিল করে তুলতে পারে।
মিথ ৩:
জুয়া আসক্তি হলো দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষের সমস্যা।
ফ্যাক্ট : অনেকের ধারণা, জুয়া আসক্তি শুধুমাত্র দায়িত্বজ্ঞান বিহীন মানুষদের সমস্যা, কিন্তু বাস্তবে এটি যেকোনো মানুষের ক্ষেত্রেই হতে পারে। এমনকি যারা সমাজে দায়িত্বশীল হিসেবে পরিচিত এবং নিয়মিত দায়িত্ব পালন করেন, তাদেরও জুয়া আসক্তির ঝুঁকি থাকে। আসক্তি মূলত মানসিক সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত, যা দায়িত্ববোধের স্তরের ওপর নির্ভর করে না। একজন ব্যক্তি যতই সামাজিক বা আর্থিকভাবে দায়িত্বশীল হোন না কেন, জুয়ার টেবিলে বা স্লট মেশিনের সামনে তারা আচমকাই পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারেন। আসক্তি যখন শুরু হয়, তখন দায়িত্ববোধ বা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি আর কাজ করে না।
মিথ ৪:
জুয়া আসক্তি কেবল প্রাপ্তবয়স্কদের সমস্যা। এটি কিশোর বা শিশুদের এড়িয়ে যায়, কারণ তারা আইনত এটি খেলতে পারে না।
ফ্যাক্ট: জুয়া আসক্তি কেবল প্রাপ্তবয়স্কদের সমস্যা নয়। যদিও আইনত শিশু এবং কিশোরদের জুয়া খেলার অনুমতি নেই, তবে বাস্তবে এই সমস্যাটি তাদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। কম বয়সী মানুষেরা অর্থের মূল্য পুরোপুরি বোঝে না, ফলে তারা সহজেই জুয়ার আসক্তিতে পড়ে যেতে পারে এবং বেশিরভাগ সময় পরিবারের খারাপ উদাহরণের কারণে এটি ঘটে। পরিবারে যদি জুয়া খেলার প্রবণতা থাকে, তাহলে ছোট সদস্যরাও তা দেখে এবং শিখে ফেলে, যা ভবিষ্যতে তাদের আসক্তির ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। পরিবারের বড়দের খারাপ উদাহরণগুলো শিশুদের ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে, তাই বয়স এখানে কোনো বাধা নয়।
মিথ ৫:
জুয়ায় আসক্ত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধ করা একটি ভালো কাজ।
ফ্যাক্ট : জুয়ায় আসক্তির সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আর্থিক দায়িত্বহীনতা। অনেকেই ভাবেন যে, আসক্ত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধ করে তাকে সাহায্য করা সম্ভব, কিন্তু এটি শুধুমাত্র সমস্যাটিকে দীর্ঘায়িত করে। জুয়া আসক্ত ব্যক্তি যদি তার আর্থিক দায়িত্ব অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে পারেন, তাহলে তিনি কখনো তার সমস্যার মূল কারণ বুঝতে পারবেন না। সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, একজন পেশাদার বিশেষজ্ঞের পরামর্শের জন্য অর্থ প্রদান করা, যাতে সেই বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি সমস্যাটি সমাধানে সাহায্য করতে পারেন। ঋণ পরিশোধ করে দিলে সমস্যার সমাধান হবে না, বরং খেলোয়াড় আরও বেশিক্ষণ দায়িত্ব এড়াতে পারবেন। তাই আর্থিক দায়িত্ব তার নিজের ওপর রাখতে হবে।